আল্লাহ রাব্বুল আলামীন যখন ছিলেন একা-ছিলনা তাঁর সখা। ছিল না তাঁর পরিচয়। তিনি ছিলেন গুপ্ত ধন ভান্ডারের ন্যায়। নিজের আত্ম পরিচয়ের ও আত্ম প্রকাশের উদ্দেশ্যে তিনি আপন যাতি নূরের ফয়েয, ঝলক ও জ্যোতি হতে সৃষ্টি করলেন আপন হাবীবের নূর মোবারক। ঐ নূরে মুহাম্মদী (দ.) হতেই পয়দা করলেন আরশ কুরছি, লাওহ-কলম, আসমান জমিন তথা সবকিছু। তখন আগুন পানি মাটি বায়ু অর্থাৎ সৃষ্টির মৌলিক কোন পদার্থের অস্তিত্ব ছিল না। সুতরাং নূরে মুহাম্মদী (দ.)হলো প্রথম মৌলিক সৃষ্টি। এই সৃষ্টির রহস্যর তো তখন কোন সাক্ষীই ছিলনা খোদা ভিন্ন।সন্তান যেমন জানেনা পিতা-মাতার সৃষ্টি রহস্য সম্পর্কে, তদ্রুপ খোদার সৃষ্টি জগতও জানেনা তাদের সৃষ্টির মূল উৎসের রহস্য সন্ধান। এমন কি ফেরেস্তাকুল শিরোমণি হযরত জিবরাইল (আ.)ও হাকিকতে মুহাম্মদী সম্পর্কে পূর্ণ অবগত ছিলেন না। তিনি শুধু একটি তারকাকে বাহাত্তর হাজার বার উদিত হতে দেখেছেন সত্তর হাজার বছর পর পর। আর সত্তর হাজার ডুবন্ত অবস্থায় বাহাত্তর হাজার বার দেখতেই পাননি। অংকের হিসাবে পাঁচশত চার কোটি বছর উদিত অবস্থায় ঐ তারকার যাহেরী সুরত মাত্র দেখেছিলেন হযরত জিবরাইল (আ.)। বাতেনীরূপে ঐ তারকা অনুরূপ পাঁচশত চার কোটি বছর উদিত অবস্থায় মোট এক হাজার আট কোটি বছর নবী করিম (দ.) নূরানী চতুর্থ হিজাবে বিদ্যমান ছিলেন। কিন্তু জিবরাইল (আ.) ঐ বাতেনী সুরতের বিষয়ে সম্যক অবগত ছিলেন না। হযরত আবু হোরায়রা (রা.)’র বর্ণিত হাদীস মোতাবেক নবী করীম রাউফুর রাহীম (দ.) জিবরাইল (আ.) কে ঐ তারকার তথ্য জানিয়ে বলেছিলেন “ আমি ছিলাম ঐ তারকা” (সীরাতে হলবিয়া ১ম খন্ড ৩০ পৃষ্টা ও রুহুল বয়ান সুরা তাওবা ১২৮ আয়াত)। সুতরাং এই হাকিকতে মোহাম্মদীর অর্ধেক বাতেনী অংশ বা বাতেনী রূপ সম্পর্কে জিবরাইলেরও জানা ছিল না প্রকৃত অবস্থা।
মেরাজ রজনীতে খোদার দীদার লাভ করে যখন নবী করিম (দ.) ফিরতি পথে একা একা ৬ষ্ঠ আকাশে নেমে আসলেন, তখন মুসা (আ.) এর অনুরোধে তিনি পুনরায় নয় বারতা আল্লাহর দরবারে একা একা আসা-যাওয়া করেছিলেন উম্মতের নামাযের সংখ্যা কমানোর জন্য। বাহ্যিক দৃষ্টিতে উম্মতে মোহাম্মদীর প্রতি মুসা আলাইহিস সালামের মায়া ও দরদ দেখা গেলেও প্রকৃত পক্ষে মুসা (আ.) এর আর একটি উদ্দেশ্য এখানে গোপনে ও প্রচ্ছন্নভাবে কাজ করছিলো। সেটা ছিল আল্লাহ নূরের তাজাল্লী দর্শনের প্রবল আকাংখা (তাফসীরে সাভী) আড়াই হাজার বছর পূর্বে তূর পর্বতে আল্লাহর নূরের জালালী তাজাল্লী সহ্য করতে না পেরে তিনি বেহুঁশ হয়ে পড়েছিলেন। আজ মেরাজ রাতে সেই নূরের তাজাল্লী নবীজীর চেহারা মোবারকে প্রতিফলিত দেখে মুসা (আ.) এর সুপ্ত বাসনা পুনরায় জেগে উঠে। তাই তিনি্ উম্মতে মুহাম্মদীর নামাযের বাহানায় পুন: পুন: নয় বার আল্লাহর নূরের দীদার নবীজীর মাধ্যমে লাভ করতে সক্ষম হয়েছিলেন। আল্লাহর প্রিয় হাবীব (দ.) হলেন আল্লাহ দর্শনের আয়না স্বরূপ (মসনবী)। এই আয়নাতেই আল্লাহর নূর প্রতিবিম্বিত হয় দেখাও সম্ভব-যেমন পূর্ণ সূর্য গ্রহণের সময় এক্সরে ফিল্মের মাধ্যমে সূর্য গ্রহণের রূপ দেখা যায়-খালী চোখে সম্ভব নয়।মসনবী শরীফে সূফী সম্রাট আল্লামা জালাল উদ্দিন রুমী (রহ.) বলেছেন, “ মোস্তফা আয়নায়ে জিল্লে খোদাস্ত, মুনআকাছ দর ওয়ায় হামা খোয়ে খোদাস্ত” অর্থ-“নবী মোস্তফা (দ.)হচ্ছেন আল্লাহর নূরানী তাজাল্লী দর্শনের আয়না স্বরূপ। ঐ আয়নাতেই আল্লাহর পবিত্র যাতের সবকিছু প্রতিবিম্বিত ও প্রতিফলিত হয় (মসনবী শরীফ)”। মাওলানা রুমীর উচ্চমার্গের এই আধ্যাত্মিক তত্ত্ব মূলত: মুসা (আ.)এর নবী দর্শনের তথ্য হতেই উৎসারিত। উপরের দুটি ঘটনা থেকে এই শিক্ষাই পাওয়া গেল যে, হাকিকতে মুহাম্মদীর স্বরূপ উদঘাটন করতে হলে হযরত জিবরাইল ও হযরত মুসা (আ.) থেকেই তথ্য সংগ্রহ করতে হবে এবং তাঁদের দৃষ্টিতেই দেখতে। চলবে—–
